সেবার অ্যানালগ জটিলতা – অসুস্থ মাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যাবেন চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের বাসিন্দা নাঈমুর রহমান। গত দেড় মাস ধরে তিনি নগরের মুনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসে ধরনা দিচ্ছেন। কিন্তু আজও পাসপোর্ট পাননি। এরই মধ্যে তার মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে।
চট্টগ্রামে ডিজিটাল সেবার অ্যানালগ জটিলতা
সোমবার (১৮ নভেম্বর) দুপুর দেড়টার দিকে পাসপোর্ট ডেলিভারির লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তখন তার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। রীতিমত ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসগুলো নামেই অনলাইন, বাস্তবে অ্যানালগ! একটি পাসপোর্ট পেতে কত ভোগান্তি পোহাতে হয় তা যিনি করেন তিনিই জানেন।’ তার মতে, নাগরিকদের সহজে পাসপোর্ট দেওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাগজের ফরম পূরণের মাধ্যমে আগে যখন পাসপোর্ট করতে হতো তখন সেবাপ্রার্থীকে দিনের পর দিন ঘুরতে হতো। এর সঙ্গে ছিল দালালদের দৌরাত্ম্য। নাগরিকদের দুর্ভোগ লাঘবে সরকার অনলাইনের মাধ্যমে পাসপোর্ট আবেদনের ব্যবস্থা করে। আশা ছিল এর মাধ্যমে জটিলতা কিছুটা কমে আসবে। কিন্তু পাসপোর্ট আবেদনের পরিমাণ দিন দিন যেভাবে বাড়তে থাকে তাতে এ পদ্ধতিও খুব একটা কাজে আসেনি।

এখন অনলাইনে পূরণ করা আবেদনের ফরম জমা দিতে আগে টোকেন নিতে হয়। এ জন্য পাসপোর্ট অফিসে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হয়। একই পদ্ধতিতে নির্ধারিত তারিখে এসে আবেদন ফরম জমা, আরেকদিন এসে আঙুলের ছাপ এবং অন্যদিন পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হয়। সবগুলো প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রত্যেকের দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগে।
সোমবার দুপুরে চট্টগ্রামের মুনসুরাবাদের বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সুশৃঙ্খল পরিবেশে পাসপোর্ট আবেদন জমা ও ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। তবে সেখানে থাকা কয়েকজন সেবাপ্রার্থীর অভিযোগ, ইশারার মাধ্যমে দালালদের ফাইল বুঝে কাজ আগে করে দেওয়া হয়।
সেখানে দেখা গেছে, নতুন আবেদনকারীদের জমার স্লিপ নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এরপর কমপক্ষে ৬-৭ দিন পর আসতে বলা হচ্ছে। ওই তারিখে অনলাইন আবেদনের কপিসহ অন্যান্য কাগজপত্র সঙ্গে আনতে হয়। কিন্তু লাইনে আগে দাঁড়ানোর যুদ্ধে জিততে হলে আসতে হয় একদম ভোরে। সকাল ১০টায় অফিস খুললেও অনেকেই বিকেল ৫টা পর্যন্ত সিরিয়ালে অপেক্ষায় থাকেন। কাগজ জমা হলে দাঁড়াতে হয় ছবি তোলার লাইনে। এভাবেই চলে যায় তিন থেকে চার দিন।
সেখানে থাকা মো. সেলিম নামে একজন বলেন, ‘ফাইল জমা দিতেই আমার দুপুর গড়াল, ছবি আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট এখনো বাকি। এর মধ্যেই শরীরের অবস্থা কাহিল। বাইরে বসারও কোনো ব্যবস্থা নেই।’ মো. নাঈমুল নামে আরেকজন বলেন, ‘আমি মিরসরাই থেকে এক দিন এসে কোনো কাজ না হওয়ায় ফিরে যাই। পরদিন আবার আসি। পাসপোর্ট পেতে দেড় মাসেরও বেশি সময় লাগল।’

এদিকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাসপোর্ট করতে গিয়ে খরচ বেড়েছে জানিয়ে মাহফুজুল হক নামে এক সেবাপ্রার্থী বলেন, ‘অনলাইনে আবেদন করতে কম্পিউটারের দোকানে ৩০০ টাকা দিতে হয়েছে। অনেকে আবার দালালের খপ্পরে পড়েন। তখন সরকারি ফি থেকে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। প্রথমে অনলাইনে আবেদন পরে সশরীরে অ্যানালগ পদ্ধতিতে সেটা জমা দেওয়া, এই মিশ্র প্রক্রিয়ার কারণে আমাদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’
মাহফুজুল হকের কথার সত্যতা মেলে পাসপোর্ট অফিসের সামনের দোকানিদের ভাষ্যে। তারা জানিয়েছেন, প্রতিটি পাসপোর্ট আবেদনে তারা ৩০০ টাকা করে নেন। আর চালান কপিতে নেন ৫০ টাকা। বর্তমানে সাধারণ ক্যাটাগরির পাসপোর্ট করতে ৫৭৫০ টাকা সরকারি খরচ হলেও অনেককে আট হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়।
সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. সাঈদুল ইসলামের কক্ষে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে একাধিকবার কল করে, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়েও তার পক্ষ থেকে কোনো উত্তর আসেনি। পরে ওই নম্বর থেকে কল করে নিজেকে পরিচালকের পিএ পরিচয় দেওয়া মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ই-পাসপোর্ট করতে সবাই সশরীরে কেন লাইনে দাঁড়ান, সেটা আমারও প্রশ্ন। তা হলে আর অনলাইন হলো কেমন করে?’

তিনি বলেন, ‘আমরা সাধারণত প্রতিদিন ৭০০-৮০০ জনের আবেদন গ্রহণ করি। কিন্তু দৈনিক আবেদনকারী আসেন ১২০০-এরও বেশি। তখন আমাদের হিমশিম খেতে হয়। আমাদের জনবলসংকট রয়েছে। স্যার (পরিচালক) বিষয়টি লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।’
আরও পড়ুন…